ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কীর্তি মানের মৃত্যু নেই…

রাসেল চৌধুরী ::
দেখা হলেই হ্যালো, হাই ইয়াংম্যান বলে ডাক দেওয়ার লোকটিকে হারিয়েছি আজ। বলছিলাম আমজাদ ভাইয়ের কথা, এডভোকেট আমজাদ হোসেন। অনেক বর্ণাঢ্য পরিচিতি তার। যৌবনের স্বর্নালী দিনগুলি কাটিয়েছেন রাজপথে। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কঠিন দু:সময়ে রাজপথকে স্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছিলেন এই আমজাদ ভাই। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও জেলাব্যাপী তাঁর ভূমিকা ছিলো প্রশংসনীয়।
রাজপথে কত রক্ত ঝরিয়েছেন তার কোন হিসেব নেই। কে রাখবে হিসেব? আওয়ামীলীগে কারো হিসেব যে কেউ রাখে না! জেলও কেটেছেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে থেকেছেন।

নব্বইয়ের দশকে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চকরিয়া উপজেলা প্রথম পৌর প্রশাসকও ছিলেন তিনি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হিসাবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। দীর্ঘ চারদশক ধরে তিনি চকরিয়া আদালত ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আইন পেশা চর্চা করেন। কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সভাপতি হিসাবে দায়িত্বপালন করেছেন কক্সবাজার জেলা কমিউনিটি পুলিশের। কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন একাধিকার। সর্বশেষ তিনি জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন। একজন সৎ, নিবেদিত প্রাণ, আদর্শিক ও কর্মীবান্ধব নেতা হিসাবে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে খুবই স্নেহ করতেন।
আমজাদ হোসেনের যে গুনটি সবাইকে মুগ্ধ করেতো তা হলো, তিনি আপাদমস্তক, নির্ভেজাল আওয়ামীলীগার হলেও তিনি ছিলেন সার্বজনীন। সব মতের, সব বয়সের মানুষকে আপন করে নেওয়ার অসাধারণ গুন ছিল তার মধ্যে। অপরিচিত লোকজনের সাথেও ভাব জমিয়ে কথা বলতেন। যেন সদ্য পরিচিত বা কথা বলা লোকটি তার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। ৭০ বছর বয়সেও চলনেবলনে তিনি ছিলেন টগবগে তরুণ। তৃণমূল নেতাকর্মীদের নাম মনে রাখার অসাধারণ স্বরণশক্তিও ছিল তার দখলে। এ রকম দ্বিতীয়জন নেই বললেই চলে। বয়স সত্তর পেরুলেও তারুণ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। সবসময় কালারফুল কাপড় পড়ে চলতে পছন্দ করতেন। রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব ও হ্নদয়ের বিশালতার কারণে তিনি অন্যাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, ব্যতিক্রম নেতৃত্ব ছিলেন। কর্মীদের যেমন মনে রাখতেন, তেমনি তাদের কষ্ট বুঝতেন। দু:খ শুনতেন। তাদের ব্যথায় ব্যতীত হতেন। দুর্বৃত্তায়নের এ সময়ে এ ধরনের নেতা ও নেতৃত্ব বিরল। আমজাদ ভাই অন্য অনেক কর্মীর মতো আমার মতো অতি সাধারণ নগন্য কর্মীর খবরও রাখতেন। তিনি জানতেন আমি দৈনিক বাকঁখালী পত্রিকায় কাজ করি। তিনি বাকখালী পত্রিকার সম্পাদককে খুবই স্নেহ করতেন। সম্পাদক সাহেবের কঠিন বিপদের সময় এ মানুষটি পাশে ছিলেন। চিহ্নিত বিএনপি, জামায়াত ও জাসদ করা লোক অথচ ক্ষমতার স্বাদ নিতে রাতারাতি আওয়ামী লীগের দরদী বনে যাওয়া কিছু সুবিধাবাদীদের কূটচালে যখন সাইফুল ইসলাম চৌধুরী জেলের অন্ধকার প্রকোষ্টে নিক্ষিপ্ত হলেন, তখন তিনি আমাদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। আমাদের শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমার সাথে দেখা হলে একবারের জন্য হলেও সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর কথা জিজ্ঞেস করতেন। বলতেন, সাইফুল কেমন আছে? পত্রিকার কি খবর? চলছে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমজাদ ভাই শুধু যে আমার, সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বা বাকঁখালী পত্রিকার খবর নিতেন তা নয়, তিনি খবর রাখতেন তৃণমূলের অগণিত, শত সহস্র নেতাকর্মীর। তিনি প্রাণের সংগঠনের দুরাবস্থা নিয়ে, হাইব্রিটদের আস্ফলন নিয়ে ভাবতেন। সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলতেন। কি দলীয় ফোরাম, কি সভা সেমিনার যেখানেই সুযোগ পেতেন বজ্রকণ্ঠে সব অনিয়ম তোলে ধরতেন।
নেতাকর্মীদের খবর নেওয়ার, বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার বা কোর্টে বিনে পয়সায় মামলায় লড়বার সদাহাস্যোজ্জল, প্রাণবন্ত, রোমান্টিক, চির তরুন মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই। হাজার হাজার নেতাকর্মী, স্বজনদের শোক সাগরে ভাসিয়ে তিনি পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। কিন্তু কর্মগুণে, একজন মানবিক মানুষ হিসাবে তিনি আমাদের মাঝে বেচে থাকবেন শত সহস্র শতাব্দিকাল। কীর্তিই বাচিয়ে রাখবে তাকে। কীর্তি মানের যে মৃত্যু নেই!

পাঠকের মতামত: